Deprecated: str_replace(): Passing null to parameter #3 ($subject) of type array|string is deprecated in /home/sva4rjsx70/public_html/common/config.php on line 186
আরিচা ঘাটের সেকাল আর একাল

আরিচা ঘাটের সেকাল আর একাল

সাভার কণ্ঠ

প্রকাশিত : ১১:৫৮ এএম, ১৯ মে ২০২৫ সোমবার

আরিচা ঘাটের সেকাল আর একাল

আরিচা ঘাটের সেকাল আর একাল

ষাটের দশক থেকে হাজার হাজার যাত্রী ও শত শত গাড়ির সমাগম ঘটত আরিচা ঘাটে। লঞ্চ ও ফেরির হুইসেল এবং মানুষের চলাচলে আরিচা ঘাট ছিল কোলাহল ও কর্মমুখর। হকার ও ফেরিওয়ালাদের হইহুল্লোড় ও হাঁকডাকে সরগরম থাকত পুরো ঘাট এলাকা। দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের মানুষের রাজধানীতে যাতায়াতের একমাত্র পথ ছিল আরিচা ঘাট। এ ঘাটকে ঘিরেই সে সময় থেকেই গড়ে ওঠে ব্যবসাকেন্দ্র।

হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বোর্ডিংয়ের ব্যবসাও ছিল জমজমাট। অনেকের জীবন–জীবিকা নির্বাহ হতো এ ঘাটকে ঘিরে। লাল বাহিনী ও সাদা বাহিনী—দুটি দলে সহস্রাধিক কুলির সংসার চলত এ ঘাটের আয়ে। এরও আগে ব্রিটিশ আমলে আরিচায় ছিল পাটের বড় গুদাম। স্টিমার (জাহাজ) ও ছান্দিনৌকায় (বিশালাকৃতির নৌকা) করে এ ঘাট থেকে পাট কিনে কলকাতায় নিয়ে যেতেন ব্যবসায়ীরা। তবে সময়ের পরিবর্তনে আরিচা ঘাটের সেই কর্মচাঞ্চল্য আর নেই। কালের বিবর্তনে আরিচা ঘাট হারিয়েছে তার জৌলুশ। সে সময়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল ও বোর্ডিংগুলো বন্ধ হওয়ায় কুলি, ফেরিওয়ালাসহ অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। এখন চিরচেনা সেই আরিচা ঘাট শুধুই স্মৃতি। তবে আজও আরিচা ঘাটের সেই নানা স্মৃতি গেঁথে আছে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় যুমনা নদীর পূর্ব পাড়ে গড়ে ওঠে আরিচা ঘাট। জেলা সদর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পশ্চিমে এ ঘাটের অবস্থান।

যেভাবে গড়ে ওঠে আরিচা ঘাট

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকেই স্টিমার ও জাহাজে করে কলকাতা থেকে বিভিন্ন পণ্য আসামে আনা–নেওয়া করা হতো। যাত্রাপথে এসব স্টিমার ও জাহাজ আরিচা এলাকায় ভিড়ত। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার কৃষিপণ্য, বিশেষ করে পাট কলকাতায় নিয়ে যেতেন ব্যবসায়ীরা। নৌপথে চলাচলে সহজ, একমাত্র মাধ্যম ও সাশ্রয়ী হওয়ায় ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্য গড়ে ওঠে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আরিচা এলাকায় যমুনা নদীর পাড়ে বড় বড় স্টিমার ও জাহাজ ভিড়ত। পরবর্তী সময়ে ঘাটে গড়ে উঠেছিল পাটের বিশাল গুদাম। সে সময় থেকেই আরিচা ঘাটের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল আরিচা ঘাটের নিত্য দিনের চিত্র ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে লেখক মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন তাঁর লেখা ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যে মানিকগঞ্জ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা নৌবন্দর থেকে বড় বড় জাহাজে পণ্য বোঝাই করে আসামে যাতায়াতের পথে আরিচায় নোঙর করত। এখানে জাহাজের চালকদের বদলির কেন্দ্র ও তাঁদের আবাসস্থল ছিল।

তবে বর্তমানে এ ঘাটের চিত্র অনেকটা বদলেছে। যমুন নদীর ভাঙনে মূল আরিচা ঘাট বিলীন হওয়ায় নদীর কিছুটা পূর্ব পাড়ে ধীরে ধীরে ঘাটটি স্থানান্তর করা হয়।

নদীবন্দরের স্বীকৃতি

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ১৯৬৩ সালের ৩১ মার্চ কর্ণফুলী নামের একটি ফেরি দিয়ে মানিকগঞ্জের আরিচা এবং পাবনার নগরবাড়ি নৌরুটের যাত্রা শুরু হয়। এর পর থেকে আরিচা-নগরবাড়ি ও আরিচা-গোয়ালন্দ (বর্তমানে দৌলতদিয়া) নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাট জমজমাট হতে থাকে। আরিচা-নগরবাড়ি হয়ে ওঠে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং আরিচা-গোয়ালন্দ হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান প্রবেশপথ।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয়ের উপপরিচালক (বন্দর কর্মকর্তা) মো. সেলিম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি গেজেট হওয়ার পর ১৯৮৩ সালের ৫ জুলাই নৌবন্দরের স্বীকৃতি পায় আরিচা ঘাট। এটি হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম প্রধান ও ব্যস্ততম নদীবন্দর। আরিচা ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার যানবাহন পারাপার হতো। প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল। নদী পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকত যানবাহন ফাইল ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের ভাষ্য, ফেরি সার্ভিস চালু হলে আরিচায় গড়ে ওঠে দুটি বড় ট্রাক টার্মিনাল, যার ধারণক্ষমতা এক হাজার ট্রাকের। যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের চাপে যানজট ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। যানজটের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো যাত্রীদের। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস পারাপার করা হলেও তিন থেকে চার দিন পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে আরিচা ঘাটের ট্রাক টার্মিনালে অপেক্ষায় থাকতে হতো। যানজটের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে ঈদের ছুটির সময়ে ঈদের নামাজ ঘাটে পড়ার ঘটনাও আছে অসংখ্য।

ঘাট ঘিরে ব্যবসা

ব্রিটিশ আমলেই আরিচা ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সে সময় আরিচা ঘাট এলাকায় পাটের গুদাম ও ঢেউটিনের গুদাম ছিল। মানিকগঞ্জ ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত এসব পাট আরিচায় গুদামে রাখা হতো। এ ছাড়া পাশের ঘিওর উপজেলায় বড় বড় পাটের গুদাম ছিল। ঘিওরের এসব গুদাম থেকে বড় বড় নৌকায় করে পাট আরিচায় আনা হতো। এরপর সেখান থেকে এসব পাট কলকাতায় নিয়ে যেতেন ব্যবসায়ীরা। মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটের টিন ও কাঠের তৈরি বোর্ডিংগুলো বন্ধ। সেখানে এখন ছোটখাটো দোকানপাট হয়েছে। সম্প্রতি আরিচা ঘাট এলাকায় ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার তেওতা একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অজয় চক্রবর্তী (৭০) ভাষ্য, ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় ভূপাল দেবনাথ নামের এক পাট ব্যবসায়ী আরিচা ঘাট এলাকায় পাটের গুদাম তৈরি করেন। তিনি দেশের উত্তরবঙ্গের পাটকলগুলোয় পাট বিক্রি করতেন। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পাটের গুদাম গুটিয়ে তিনি ভারতে চলে যান।

নদীবন্দর হওয়ায় অসংখ্য মানুষ ও যানবাহনের আনাগোনায় আরিচা ঘাট এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ঘাটে আটকে থাকায় যাত্রী ও পরিবহনশ্রমিকদের জন্য গড়ে ওঠে শতাধিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বোর্ডিং। দুই থেকে তিন দিন ঘাটে আটকে থাকতে হলে তাঁরা এসব বোর্ডিংয়ে রাত যাপন করতেন।

ঘাটে একসময় মোহাম্মদিয়া হোটেল অ্যান্ড বোর্ডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল শিবালয়ের সাকরাইল গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত খলিলুর রহমানের। তাঁর ছেলে ফরিদ হোসেন বলেন, আরিচা ঘাটের যখন পুরো ‘যৌবনকাল’, সে সময়ে জমজমাট ছিল হোটেল ও বোর্ডিংয়ের ব্যবসা। ঘাটের অপেক্ষমাণ যাত্রী ও পরিবহনশ্রমিকদের রাতযাপনের জন্য প্রায় অর্ধশত হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বোর্ডিং পরিপূর্ণ থাকত। মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটে যাত্রীর আনাগোনা নেই বললেই চলে। নেই কর্মব্যস্ততাও। এক সময়ের ব্যস্ত জায়গাটি এখন অনেকটাই নীরব ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় অন্বয়পুর গ্রামের বাসিন্দা রঘুনাথ বিশ্বাস (৬৭) বলেন, ১৯৬৮ সাল থেকে তাঁর বাবা বিশ্বনাথ বিশ্বাস নওগাঁসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান ও চাল কিনে ছান্দিনৌকায় করে আরিচা ঘাটে নিয়ে আসতেন। পরে এসব ধান ও চাল মানিকগঞ্জে বিক্রি করতেন। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তাঁদের এই ব্যবসা ছিল।

ঘাট এলাকায় ব্যবসায়ী ও যাত্রীদের মালামাল বহন করতেন কুলিরা। কুলিদের মধ্যে দুটি দল ছিল। একটি লাল বাহিনী, অপরটি সাদা বাহিনী। ১৯৭২ সালের দিকে স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রশিদ ওরফে লেবু কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। পাঁচ শতাধিক কুলি যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের মালামাল ফেরি ও নৌকায় ওঠাতেন ও নামাতেন।

বদলেছে দৃশ্যপট

আরিচা ঘাট বা বন্দরের সেই চিরচেনা দৃশ্য এখন আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরিচার চিত্র পাল্টেছে। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। যমুনা নদীতে নাব্যতা–সংকটের কারণে ২০০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আরিচা ফেরিঘাট স্থানান্তর করা হয় পাটুরিয়ায়। হারাতে থাকে তার চিরচেনা সেই রূপ। আরিচা ঘাটের দ্বিতল বোর্ডিংগুলো বন্ধ। সম্প্রতি আরিচা ঘাট এলাকায় ছবি: প্রথম আলো

ঘাট সরিয়ে নেওয়ায় আরিচায় যাত্রী ও যানবাহনের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায়। একসময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আরিচা ঘাটে এখন অনেকটাই সুনশান নীরবতা। একে একে সব হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বোর্ডিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা। বেকার হয়ে পড়েন শত শত কুলি ও ফেরিওয়ালা।

শিবালয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, একসময়ের ব্যস্ততম নদীবন্দর যাত্রী ও যানবাহনের আনাগোনায় ভরপুর থাকত। এখন কুলি, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক নেই। ঘাট ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য, যাত্রী ও যানবাহনের চাপ নেই। এখন সবই শুধু স্মৃতি।

দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এই ঘাটে পুনরায় ফেরি চালু হলেও তা সীমিত পরিসরে। এখন আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে পাঁচটি ফেরি থাকলেও এই নৌপথে যাত্রীবাহী কোনো বাস পারাপার হয় না। মালবাহী গুটিকয় যানবাহন পারাপার হয়ে আসছে। লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রী পারাপার হচ্ছে এখন। তবে যাত্রীর সংখ্যা সামান্যই। অধিকাংশ সময় লঞ্চ ও স্পিডবোটগুলোকে যাত্রীর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। এখন আরিচা ঘাট এলাকায় কিছু দোকানপাট ও স্থানীয়ভাবে ছোট পরিসরে বাজার গড়ে উঠেছে। মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটে ছোটখাটো খাবারের হোটেলে নেই ক্রেতা। সম্প্রতি আরিচা ঘাট এলাকায় ছবি: প্রথম আলো সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা দেখা গেছে, টিন ও কাঠের তৈরি দ্বিতল কয়েকটি হোটেল ও বোর্ডিং বন্ধই আছে। কোনো কোনো হোটেল ও বোর্ডিংয়ে মুদিদোকানসহ ছোটোখাটো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

আরিচা ঘাটের শত স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় ঘাইটঘর তেওতা গ্রামের কিতাব আলী শেখ (৮০)। ৪২ বছর তিনি এ ঘাটে কুলির কাজ করেছেন। বলেন, ‘সে সময় চাল, আটা, চিনির বস্তা টানছি। নদীতে স্টিমার থেইক্যা টানে (নদী তীরে) উঠাইতাম। বেশ আয়রোজগার হইতো। ২০ বছর আগে ঘাট সইর‍্যা গেলে আমরাও বেকার হয়ে পড়ি। আয়রোজগারও বন্ধ হয়ে যায়। এহনো স্মৃতির টানে আরিচাতে আসি।